
কেন এটুকু জিনিস এতটা অপরিহার্য হয়ে উঠল? চলুন, জেনে নিই।বহুল প্রচলিত কাহিনি বলে, নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ যখন ব্রিটিশদের কারণে সিংহাসন হারিয়ে ১৮৫৬ সালে কলকাতায় নির্বাসনে এলেন, তখন তার জীবিকা চলত ব্রিটিশদের দেওয়া পেনশনে। নবাব রাজকীয় ভঙ্গিতে জীবনযাপন করতেন, কিন্তু মাংস কিনে বিরিয়ানি রান্নার খরচ সামলানো যাচ্ছিল না।সমাধান হিসেবে নবাব বললেন, মাংস কমিয়ে আলু দিতে। এতে খরচও বাঁচবে, খাবারও বেশি লাগবে।এই গল্প বহু মানুষ বিশ্বাস করলেও নবাবের উত্তরসূরিরা এটিকে নিছক গালগল্প বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।
তাহলে সত্যিটা কী? তিনটি প্রধান তত্ত্ব সামনে এসেছে
১. আলু ছিল নবাবি এক্সপেরিমেন্টের অংশ
নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ মূলত নতুন জিনিসে আগ্রহী ছিলেন। সে সময় আলু ছিল একদম নতুন এক সবজি পাশাপাশি দামি ও আকর্ষণীয়। বিরিয়ানি রান্নায় আলু যুক্ত করা হয়েছিল।এবং সেই স্বাদ এতটাই ভালো লেগেছিল, যে তা রয়ে যায়। নবাব পরিবারের উত্তরসূরি মনজিলাত ফতিমা বলেন, মাংসের দাম কমানোর জন্য নয়, বরং রান্নায় বৈচিত্র আনতেই আলু ঢুকেছিল। বরং সে সময় আলুর দামই বেশি ছিল। তিনি আরো বলেন, ‘নবাব বছরে প্রায় ১২ লক্ষ রুপির পেনশন পেতেন, এমনকি মেটিয়াবুরুজে নিজের পশু-পাখির চিড়িয়াখানায় বাঘ-সিংহের জন্য কিলোকিলো মাংস কিনতেন। যার পোষা বাঘের জন্য মাংস কেনা যায়, তার নিজের বিরিয়ানিতে মাংস থাকবে না – এমনটা অবিশ্বাস্য।
২. আলু এসেছে বাঙালির ‘দুর্বল হজম’ এর কারণে
জহর সরকার, প্রাক্তন সাংসদ ও ইতিহাস গবেষক, বলেন বাঙালির হজম ক্ষমতা নবাবি খাওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল না। অতিরিক্ত তেল-ঘি-মশলা হজম করতে না পেরে আলু যুক্ত করা হয়। কারণ আলু মশলা শোষণ করে রান্নাকে হালকা করে তোলে। এভাবে আলু ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
৩. আলুর সংযোজন হয়েছে অনেক পরে, স্বাধীনতার পর
অনেক গবেষক মনে করেন, নবাব যদি বিরিয়ানি আনেন ১৮৫৬-তে, বাংলায় তার জনপ্রিয়তা আসে ষাটের দশকে – মানে প্রায় ১০০ বছর পরে। ১৯৫০ বা ৬০-এর দশকে, যখন বিরিয়ানি মধ্যবিত্তের মধ্যে ছড়াতে শুরু করে, তখন মাংসের পরিমাণ কমিয়ে সস্তায় বেশি পরিবেশন করতেই আলুর প্রবেশ ঘটে।
কী বলছে ইতিহাস?
আলু ভারতীয় উপমহাদেশে আসে পর্তুগিজদের হাত ধরে, ১৭শ শতকে। প্রথম আলু চাষ হয় পশ্চিম ভারতে। বাংলায় এর চাষ শুরু হয় ১৮২০-এর দশকে উইলিয়াম কেরির উদ্যোগে। আলু-পোস্ত জনপ্রিয় হতে শুরু করে নিম্নবিত্তদের মধ্যে এবং ধীরে ধীরে শহুরে ধনীদের খাবারে স্থান পায়। নবাবের সঙ্গে আসা বাবুর্চি, খানসামারা কলকাতার বাবুদের বাড়িতে রান্না করতে গিয়ে সেই বাবুদের পছন্দমতো হালকা রান্নায় আলু যুক্ত করেন।
তাহলে সত্যি কী?
হয়তো সব তত্ত্বই আংশিকভাবে সত্য।
আলু একদিকে এক্সপেরিমেন্ট, আবার অপরদিকে অর্থনৈতিক-সামাজিক বাস্তবতা। এক জায়গায় নবাবি রুচি, আরেক জায়গায় মধ্যবিত্তের পেট বাঁচানো কৌশল। এক শতকের নানা ধাপে, নানা রকম কারণে আলু বাংলার বিরিয়ানিতে তার স্থায়ী আসন গড়ে নেয়।
আজকের বাস্তবতা
যেভাবেই হোক, এখন আলু ছাড়া বিরিয়ানি কল্পনা করা যায় না। মাংস-ঘি-মসলার সুঘ্রাণে আলু হয়ে ওঠে এক অনন্য স্বাদে ভরপুর উপাদান। অনেকে তো বলেন, বিরিয়ানির আসল তারকা হচ্ছে সেই আলুই। সিঙাড়ায় আলু না থাকলে অসম্পূর্ণ লাগে, তেমনি বিরিয়ানিতে আলু না থাকলে খাবারটা যেন কিছু একটা হারিয়ে ফেলে। বাংলার বিরিয়ানির আলু, শুধু একটি উপাদান নয় – এটি একটি ইতিহাস, একটি স্বাদ এবং অনেকটা আত্মপরিচয়েরও প্রতীক।